ভারতবর্ষ ভাগ হয়েছিল মুসলমান জনসাধারণের প্রতিনিধি দল মুসলিম লীগের ভারতবর্ষের মুসলমানপ্রধান অংশগুলিকে নিয়ে আলাদা পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের দাবীতে। ১৯৪৬ সালের ব্রিটিশ ভারতের নির্বাচনে মুসলিম লীগের জয় দাবীটিকে আরাে শক্তিশালী করে। বিভিন্ন কারণে দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল ভারতের জাতীয় কংগ্রেস এই দাবী মেনে নেয়। ১৯৪৭ সালে যখন ব্রিটিশ সরকারের আর ভারতে রাজত্ব চালানাের শক্তি ছিল না তখন তারা ভারতবর্ষকে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করে স্বাধীনতা প্রদান করেন। ভারতবর্ষের পশ্চিমের মুসলমানপ্রধান সিন্ধু প্রদেশে, বালুচিস্তান, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ পাকিস্তানে অন্তর্ভূক্ত হয়। পাঞ্জাব রাজ্যকে দুভাগ করে পশ্চিমের মুসলমানপ্রধান অংশ যায় পাকিস্তানে এবং হিন্দু-শিখ প্রধান অংশ থাকে ভারতে। ১৯৪১ সালের জনগণনা অনুযায়ী যুক্ত বাংলায় (বর্তমান বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ) মুসলমানরা ছিল ৫৬% আর হিন্দুরা ছিল ৪৪%। দুটি পক্ষের মধ্যে জনসংখ্যায় তফাৎ খুব বেশি ছিল না। কিন্তু মুসলিম লীগ ও কমুনিষ্ট পার্টি চেয়েছিল পুরাে বাংলাই যাক পাকিস্তানে। ফলে বাংলা ভাগ হবে কিনা না কোন দেশে যুক্ত হবে তা নিয়ে ১৯৪৭ সালের ২০শে জুন বঙ্গীয় আইনসভায় ভােটাভুটি হয়। সেদিন বঙ্গীয় আইনসভা ভেঙে তৈরী হল পূর্ববঙ্গ আইনসভা ও পশ্চিমবঙ্গ আইনসভা। বাংলার হিন্দু প্রধান অংশগুলির প্রতিনিধি নিয়ে তৈরি হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ আইনসভা। এই ভােটে তফসিলি প্রতিনিধিরা সহ সব হিন্দু প্রতিনিধিই বাংলা ভাগ করে পশ্চিমবঙ্গ গঠনের পক্ষে ভােট দেন।
এই দেশভাগের সময় অর্থাৎ ১৯৪৭-এর কিছু আগে ও পরে পাঞ্জাবে হিন্দু ও শিখদের সঙ্গে মুসলমানদের রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা চলে বেশ কিছুদিন। পাঞ্জাবের পশ্চিমাংশ যায় পাকিস্তানের ভাগে, পূর্ব অংশ পড়ে ভারতে। সেখানে দু পক্ষের মানুষেরাই দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হতে থাকেন। ফলে দেশভাগের পরেই পাঞ্জাব প্রদেশে জনবিনিময় হয় অর্থাৎ মুসলমানরা পাকিস্তানের পাঞ্জাবে চলে যায়, হিন্দু-শিখর ভারতের পাঞ্জাবে চলে আসেন। ফলে ভারতের পাঞ্জাবে যেমন মুসলমান প্রায় নেই বললেই চলে তেমনি পাকিস্তানের পাঞ্জাবে হিন্দু-শিখ নেই। বিপুল সংখ্যার সর্বস্বাস্ত হিন্দু ও শিখ উদ্বাস্তুরা পাঞ্জাব ও দিল্লি অঞ্চলে বড় সমস্যার কারণ হয়। একই সমস্যা পাকিস্তানেও ঘটে। এটা হল পশ্চিম সীমান্তের উদ্বাস্তু সমস্যা।
বাংলায় হিন্দু মুসলমান সাম্প্রদায়িক সম্পর্ক কখনােই ভাল ছিল না। দেশভাগের ঠিক আগে ভারত ভেঙে পাকিস্তান গড়বার দাবীতে ১৯৪৬ সালের ১৬ই আগস্ট মুসলিম লীগের নেতা মহম্মদ আলি জিন্না ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে বা প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের ডাক দেন। সেই দিন কলকাতা ময়দানে বিশাল জনসভা হয় যাতে ভিড়ের জন্য আমন্ত্রিত হয়েও উপস্থিত থাকতে পারেন নি কমুনিষ্ট নেতা জ্যোতি বসু। এই সভা থেকেই শুরু হয় কলকাতা জুড়ে হিন্দুদের উপর নারকীয় আক্রমণ। এটি করা হয় তখন বাংলার প্রধানমন্ত্রী (এখানকার মুখ্যমন্ত্রী) মুসলিম লীগ নেতা শহীদ সুরাবদীর নেতৃত্বে। দুদিন পর এই আক্রমণের রূপ পাল্টে যায়, হিন্দু শিখদের প্রতিরােধে পরে তিন দিন মুসলমানরা বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হন। কয়েক হাজার মানুষ এই দাঙ্গায় নিহত হন যাকে বলা হয় গ্রেট ক্যলকাটা কিলিং। এর বদলা নিতে দুমাস পরে ১৯৪৬-এর পুর্ববঙ্গের নােয়াখালিতে বেশ কয়েকদিন ধরে চলে হিন্দু গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, ও ধর্মান্তর। এসবের পরেই বাংলা ভাগ করার ব্যাপারটি নিশ্চিত হয় যায়। স্বাধীনতার ঠিক আগে মে মাসেই শ্যামাপ্রসাদ মুখােপাধ্যায় একটি চিঠিতে ব্রিটিশ সরকারকে পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে জনবিনিময়ের প্রস্তাব দেন কিন্তু তা গ্রাহ্য হয় নি। ফলে সেসময় জনবিনিময় হলাে না।
ঠিক স্বাধীনতার সময়ে বাংলা শান্ত ছিল ফলে জনবিনিময়ের কথাটা চাপা পড়ে যায়। কিন্তু এক বছর না কাটতেই পূর্ব পাকিস্তানে শুরু হয়ে গেল ক্রমাগত হিন্দু নির্যাতন, হিন্দু উদ্বাস্তুরা পশ্চিমবঙ্গে আসতে শুরু করলেন। পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তু সমস্যার শুরু যা আজও শেষ হবার লক্ষণ নেই।
পাঞ্জাব ও বাংলা—একই সময় ভাগ হয়েছিল, পাঞ্জাবে কি এখানাে উদ্বাস্তু সমস্যা আছে না, পাঞ্জাবে কোন উদ্বাস্তু সমস্যা অনেক বছর ধরেই নেই। আগেই বলা হয়েছে যে দুই
পাঞ্জাবের মধ্যে বছরখানেকের মধ্যেই এক ধরণের জনবিনিময় সমাপ্ত হয়ে যায়। সুতরাং নতুন করে আর উদ্বাস্তু আসার কোন ব্যাপার ছিল না। প্রাথমিকভাবে প্রায় ৫০ লক্ষ হিন্দু শিখ উদ্বাস্তু যেমন ভারতে আসনে তেমনি প্রায় সমসংখ্যক মুসলমান ভারতের পাঞ্জাব ছেড়ে চলে যান। সেজন্য সমস্যার চাপটি অনেক কমে যায়। এর পর কয়েক দশকে উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের সমস্যা মিটে গেছে, বরং এই উদ্বাস্তুদের অনেকেই অনেক উন্নত জীবনযাত্রায় ফিরতে পেরেছেন। ভারতের বিগত প্রধানমন্ত্রী শ্রী মনমােহন সিং ছিলেন এরকম একজন সর্বান্ত উদ্বাস্তু।
তাহলে বাংলার উদ্বাস্তু সমস্যা কোনদিনই মিটলাে না কেন
এই প্রশ্নের উত্তর অনেকটা বড়ো হবে। প্রথম আমরা জানবাে কেন বা বিশেষতঃ কার জন্য পশ্চিমবঙ্গকে এই ভয়ংকর উদ্বাস্তু সমস্যা আজও বইতে হচ্ছে। এরপর উদ্বাস্তু সমস্যার দুটি ভাগ এক, পূর্ব পাকিস্তানের সময় ও দুই বাংলাদেশের সময়ের কথা আলােচনা করব। আলােচনা করব হিন্দু উদ্বাস্তুদের শত্রুদের ও অনুপ্রবেশ নিয়েও।
সোর্স - ইন্টারনেট।
0 Comments